আমি যখন পাঠশালাতে যাই আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে, দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে। "চুড়ি চা--ই, চুড়ি চাই' সে হাঁকে, চীনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে, যায় সে চলে যে পথে তার খুশি, যখন খুশি খায় সে বাড়ি গিয়ে। দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে, নাইকো তাড়া হয় বা পাছে দেরি। ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে অম্নি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি। আমি যখন হাতে মেখে কালি ঘরে ফিরি, সাড়ে চারটে বাজে, কোদাল নিয়ে মাটি কোপায় মালী বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মাঝে। কেউ তো তারে মানা নাহি করে কোদাল পাছে পড়ে পায়ের 'পরে। গায়ে মাথায় লাগছে কত ধুলো, কেউ তো এসে বকে না তার কাজে। মা তারে তো পরায় না সাফ জামা, ধুয়ে দিতে চায় না ধুলোবালি। ইচ্ছে করে আমি হতেম যদি বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালী। একটু বেশি রাত না হতে হতে মা আমারে ঘুম পাড়াতে চায়। জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে পথে পাগড়ি প'রে পাহারওলা যায়। আঁধার গলি, লোক বেশি না চলে, গ্যাসের আলো মিট্মিটিয়ে জ্বলে, লণ্ঠনটি ঝুলিয়ে নিয়ে হাতে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির দরজায়। রাত হয়ে যায় দশটা এগারোটা কেউ তো কিছু বলে না তার লাগি। ইচ্ছে করে পাহারওলা হয়ে গলির ধারে আপন মনে জাগি।
যেমন ঝড়ের পরে আকাশের বক্ষতল করে অবারিত উদয়াচলের জ্যোতিঃপথ গভীর নিস্তব্ধ নীলিমায়, তেমনি জীবন মোর মুক্ত হোক অতীতের বাষ্পজাল হতে, সদ্যনব জাগরণ দিক শঙ্খধ্বনি এ জন্মের নবজন্মদ্বারে। প্রতীক্ষা করিয়া আছি-- আলো হতে মুছে যাক রঙের প্রলেপ, ঘুচে যাক ব্যর্থ খেলা আপনারে খেলেনা করিয়া, নিরাসক্ত ভালোবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে শেষ মূল্য পায় যেন তার। আয়ুস্রোতে ভাসি যবে আঁধারে আলোতে, তীরে তীরে অতীত কীর্তির পানে ফিরে ফিরে না যেন তাকাই; সুখে দুঃখে নিরন্তর লিপ্ত হয়ে আছে যে আপনা আপন-বাহিরে তারে স্থাপন করিতে যেন পারি, সংসারের শতলক্ষ ভাসমান ঘটনার সমান শ্রেণীতে, নিঃশঙ্ক নিস্পৃহ চোখে দেখি যেন তারে অনাত্মীয় নির্বাসনে। এই শেষ কথা মোর, সম্পূর্ণ করুক মোর পরিচয় অসীম শুভ্রতা।
ওগো তরুণী, ছিল অনেক দিনের পুরানো বছরে এমনি একখানি নতুন কাল, দক্ষিণ হাওয়ায় দোলায়িত, সেই কালেরই আমি । মুছে-আসা ঝাপসা পথ বেয়ে এসে পড়েছি বনগন্ধের সংকেতে তোমাদের এই আজকে-দিনের নতুন কালে । পারো যদি মেনে নিয়ো আমায় সখা বলে । আর কিছু নয়,আমি গান জোগাতে পারি তোমাদের মিলনরাতে আমার সেই নিদ্রাহারা সুদূর রাতের গান; তার সুরে পাবে দুরের নতুনকে, তোমার লাগবে ভালো, পাবে আপনাকেই আপনার সীমানার অতীত পারে । সেদিনকার বসন্তের বাঁশিতে লেগেছিল যে প্রিয়বন্দনার তান আজ সঙ্গে এনেছি তাই, সে নিয়ো তোমার অর্ধনিমীলিত চোখের পাতায়, তোমার দীর্ঘনিশ্বাসে । আমার বিস্মৃত বেদনার আভাসটুকু ঝরা ফুলের মৃদু গন্ধের মতো রেখে দিয়ে যাব তোমার নববসন্তের হাওয়ায়। সেদিনকার ব্যথা অকারণে বাজবে তোমার বুকে; মনে বুঝবে, সেদিন তুমি ছিলে না তবু ছিলে, নিখিল যৌবনের রঙ্গভূমির নেপথ্যে যবনিকার ও পারে । ওগো চিরন্তনী, আজ আমার বাঁশি তোমাকে বলতে এল-- যখন তুমি থাকবে না তখনো তুমি থাকবে আমার গানে । ডাকতে এলেম আমার হারিয়ে-যাওয়া পুরোনোকে তার খুঁজে-পাওয়া নতুন নামে । হে তরুণী, আমাকে মেনে নিয়ো তোমার সখা বলে, তোমার অন্যযুগের সখা ।